নিছক চুরির দ্বারা কোন ব্যক্তির উপর চুরির হদ্দ হস্ত কর্তনের দণ্ড প্রযোজ্য হয় না। বরং এই হস্ত কর্তনের শাস্তির জন্যে কিছু শর্ত চোরের মধ্যে, কিছু শর্ত চুরিকৃত বস্তুর মধ্যে, কিছু শর্ত চুরিকৃত মালের স্থানের মধ্যে এবং কিছু শর্ত চৌর্যকর্মের মধ্যে থাকা অপরিহার্য। অন্যথায় চুরির অপরাধে চোরের হাত কাটার শাস্তি দেওয়া যাবে না। বরং তাকে তখন তার তা’যীরের আওতায় সাজা দেওয়া হবে।
বস্তুত এই প্রেক্ষিতে চুরির ‘রুকন’ তথা মৌলস্তম্ভ হলো, চারটি: ১. চোর ২. চুরিকৃত বস্তু ৩. চুরিকৃত বস্তুর স্থান এবং ৪. চৌর্যকর্ম। এবং পরে প্রত্যেকটির জন্যেই স্বতন্ত্র শর্তাবলী রয়েছে। নিম্নে তা ক্রমানুসারে প্রদত্ত হলো:
১. চোর। চোরের মধ্যে ৭টি শর্ত থাকা আবশ্যক। যথাঃ
১. বালিগ তথা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। সুতরাং ‘নাবালিগ’ তথা অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক বালিকার চুরির দায়ে ‘হস্ত কর্তন’ করা যাবে না। তবে নাবালিগকে চুরির অপরাধে তাযীরের আওতায় শাস্তি দেওয়া যাবে।
২. ‘আকল’ তাথ জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া। সুতরাং কোন অপ্রকৃতিস্থ পাগলের দ্বারা যদি চৌর্যকর্ম সংঘটিত হয় তাহলে ঐ চুরির দায়ে তার হস্ত কর্তন করা যাবে না। কেননা শিশুর মত পাগল শরী’য়তের আদেশ নিষেধ বিধি-বিধান এবং শাস্তির গণ্ডির বাইরে।
৩. যার নিকট থেকে চুরি করা হয়েছে চোর এবং তার মধ্যে নসব এর সম্পর্ক না থাকে। যদি ‘নসব’ এর সম্পর্ক থাকে, তাহলে চুরির হদ্দ হস্ত কর্তনের শাস্তি দেওয়া যাবে না। সুতরাং পিতামাতা যদি স্বীয় সন্তানের সম্পদ চুরি করে, তাহলে তার হাতকাটা যাবে না। অনুরূপভাবে, ছেলেমেয়ে যদি স্ত্রী ও পিতামাতার সম্পদ চুরি করে, তাহলে তারও হস্তচ্ছেদন করা যাবে না।
৪. চোর এবং যার মাল চুরি করা হয়েছে তাদের পরস্পরের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক না থাকা। স্বামী-স্ত্রী একের মাল অন্যে চুরি করলে হস্ত কর্তনের শাস্তি প্রযোজ্য হয় না।
৫. চোর এবং যার মাল চুরি করা হয়েছে, তার সাথে অভিভাবকত্ব এবং অধিকারের সম্পর্ক না থাকা। যেমন মুনীব ও ভৃত্যের সম্পর্ক। সুতরাং মুনীব যদি স্বীয় ভূত্যের সম্পদ চুরি করে তাহলে তার হাতকাটা হবে না। তেমনিভাবে ভৃত্য যদি স্বীয় মুনীবের মাল চুরি করে তাহলে তারও হস্তচ্ছেদন করা হবে না।
৬. চোরকে চৌর্যকর্ম নিজ ইচ্ছায় সম্পন্ন করতে হবে। যদি সে কারও চাপের মুখে
বাধ্য হয়ে চুরি করে, তাহলে তার হস্ত কর্তন করা হবে না। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় স্বাধীনভাবে এবং অন্যের চাপ ও প্রভাবমুক্ত অবস্থায় চোর যদি চৌর্যকর্ম সম্পাদন করে, তাহলেই ৭. দারুল হারবে যুদ্ধরত অবস্থায় চৌর্যকর্ম সংঘটিত না হওয়া। যেমন কোন
ভার হাত কাটা হবে, অন্যথায় নয়।
জাহিদ দারুল হারবের রণাঙ্গনে ‘মালে গনীমত’ তথা যুদ্ধলব্ধ মাল থেকে যদি চুরি করে তাহলে তার হাত কাটা যাবে না। কেননা, জিহাদের ময়দানে এবং দারুল হারবে হুদুদ কার্যকর হতে পারে না।
২. চুরিকৃত মালঃ চুরিকৃত মালের মধ্যে ছয়টি শর্ত থাকা আবশ্যক। যথা।
১. নিসাবঃ চুরিকৃত মাল ‘নিসাব’ পরিমাণ হতে হবে। অতএব নিসাব পরিমাণ থেকে কম মাল চুরি করার অপরাধে কারও হাত কাটা যাবে না। চুরির মালের নিসাবের পরিমাণ নিয়ে ইমামগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। হানাফী মাযহাবের ইমামগণের মতে, চুরির মালের ‘নিসাব’ হলো এক দীনার অথবা দশ দিরহাম কিংবা এতদোভয়ের যে কোন একটির সমমূল্য। বস্তুত হানাফী হাযহাব অনুযায়ী এক দীনার বা দশ দিরহাম অথবা এতদোভয়ের যে কোন একটি সমমূল্য পরিমাণ যদি চুরি করা না হয়, তাহলে চোরের হাত কর্তন করা হবে না।
২. মালঃ চুরিকৃত বস্তু ‘মাল’ হতে হবে। হতে হবে তা এমন বস্তু শরী’য়তের দৃষ্টিতে যার মালিক হওয়া যায় এবং যার ক্রয়-বিক্রয় হালাল ও বৈধ। চুরিকৃত বস্তু ‘মাল’ হওয়ার মর্ম হলো-এর আর্থিক মূল্য থাকতে হবে। যে বস্তুর আর্থিক মূল্য নেই তা হস্তগত করলে চুরি বলে গণ্য হবে না এবং তা চুরির শাস্তি ‘হদ্দ’ এর আওতায় পড়বে না। এমনিভাবে মালিক হওয়ার অর্থ হলো, যে সম্পদ বেচাকেনার দ্বারা আইনত অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। সে সম্পদে অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় না, সেই মাল চুরি করার অপরাধে কারও হাত কাটা যাবে না। যে জিনিস ইসলামী শরী’য়তে ক্রয় বিক্রয় করা নাজায়িয, সেই জিনিস চুরি করার দায়ে কারও উপর চুরির ‘হদ্দ’ হস্ত কর্তন প্রয়োগ করা যাবে না। যেমন শরাব, শূকর, বাদ্যযন্ত্র কেউ যদি চুরি করে, তাহলে এই জন্যে তার হাত কাটা হবে না। কারণ (শরী’য়তের দৃষ্টিতে) এগুলো মাল হওয়ার মর্যাদা রাখে না এবং শরী’য়ত অনুযায়ী এগুলো বেচাকেনাও জায়িয নয়।
৩. অধিকার: চুরিকৃত মালের মধ্যে চোরের কোনরূপ অধিকার না থাকা যেমন কেউ যদি তার কোন জিনিস অন্যের কাছে বন্ধক রাখে এবং পরবর্তীতে তাই চুরি করে নিয়ে আসে। অথবা অন্যের কাছে নিজের কোন বস্তু ভাড়া বা কেরায়া দিয়ে তা আবার চুরি করে, তবে এরূপ চুরির অপরাধে তার হাতকাটা যাবে না। অনুরূপবাবে, চুরিকৃত মালের মধ্যে চোরের অধিকারের কোনরূপ সম্ভাবনা না থাকা একটি শর্ত। যেমন গনীমতের মালও রাষ্ট্রীয় সম্পদ। কেননা এতদোভয়ের মধ্যে প্রত্যেক নাগরিকেরই পরোক্ষ অধিকার থাকে। অতএব, কেউ যদি রাষ্ট্রীয় সম্পদ কিংবা রাষ্ট্রীয় কোষাগার অথবা যুদ্ধলব্ধ মাল থেকে চুরি করে, তাহলে তাকে তা’যীরের আওতায় সাজা দেওয়া • হবে তার হাত কাটা হবে না। ৪. চুরি হয় এমন বস্তুঃ এমন বস্তু চুরি করা যা সাধারণত চুরি করা সম্ভব। যেমন- অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু কিশোর কিংবা বয়স্ক বোবা লোককে অপহরণ করা। পক্ষান্তরে, বয়স্ক লোক কিংবা বাক-সম্পন্ন ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গেলে, তা চুরির আওতায় পড়বে না। আর একারণে তার হাতও কাটা হবে না।
৫. স্থানান্তর বা হস্তান্তরযোগ্য হওয়া: চুরিকৃত মাল স্থানান্তর যোগ্য হওয়া চুরির ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কারণ চুরির অর্থই হলো, অন্যের সম্পদ সরিয়ে নিজের দখলে নিয়ে যাওয়া। আর এটা কেবল স্থানান্তরযোগ্য সম্পদের বেলাই সম্ভব। যেসব মাল এক স্থান থেকে সরিয়ে অন্যস্থানে নেওয়া যায় না তা দখল করা অবৈধ হলেও তাকে চুরি বলা হয় না।
৬. দখলভুক্ত হওয়া: চুরিকৃত মাল অপরের দখলভুক্ত হওয়া অর্থাৎ চুরিকৃত মাল অন্যের মালিকানাধীন থাকতে হবে। কারও দখলবিহীন বা মালিকানা বিহীন কোন মাল যদি কেউ হস্তগত করে কিংবা নিয়ে যায়, তাহলে তা চুরি বলে গণ্য হবে না এবং এ কারণে তার হাতকাটা হবে না।
৩. চুরিকৃত বস্তুর স্থান: এর জন্যে শর্ত হচ্ছে, চুরিকৃত মাল সংরক্ষিত স্থানে থাকা। বস্তুত যে বস্তুর সংরক্ষণের জন্যে যে স্থান নির্ধারিত সেটিই ঐ বস্তুর স্থান হিসেবে গণ্য। যেমন-মানুষের মাল আসবাব অর্থ সম্পদ সংরক্ষণের জন্য বাড়ি ঘর, দোকান পাট অফিস, মালখানা, ট্রেজারি ইত্যাদি। গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, উষ্ট্র, অশ্ব, হাতীর জন্যে গোয়াল, খোঁয়াড়, আস্তাবল প্রভৃতি। ফসলের জন্যে গোলা মরাই। ফুল ফলের জন্যে বেড়া, প্রাচীর পরিবেষ্টিত বাগ বাগিচা। নৌকা, লঞ্চ, কার্গো জাহাজের জন্যে নোত্র, খাঁড়ি, নৌঘাটি, বন্দর প্রভৃতি। গাড়ীর জন্যে গ্যারেজ, বিমানের জন্যে বিমান বন্দর। রেলের জন্যে স্টেশন, বাস, কোচ, ট্রাকের জন্যে টার্মিনাল সংরক্ষিত স্থান। সে সাথে যে জিনিসের জন্যে পাহারাদার নিযুক্ত আছে, সেটাই তার জন্যে সংরক্ষিত স্থান। মোদ্দাকথা, যে বস্তুর জন্যে যা সংরক্ষিত স্থানরূপে বিবেচিত সেখান থেকে যদি তা চুরি করা হয়, তবেই চোরের হাত কাটা হবে। পক্ষান্তরে সংরক্ষিত স্থান ছাড়া অন্য কোথাও থেকে কোন বস্তু যদি কেউ চুরি করে তাহলে তার উপর হস্ত কর্তনের শাস্তি প্রয়োগ করা হবে না।