মদ সম্পর্কে কুরআন মজীদে চারখানা আয়াত নাযিল হয়েছে। মদ সম্পর্কে প্রথমে যে আয়াত নাযিল হয় তাতে মদের বৈধতার প্রতি ইংগিত ছিল। আয়াতটি মক্কা মুকাররমায় অবতীর্ণ হয়। ইরশাদ হয়েছে:
و من ثمرات التخيل والأَعْنَابِ تَتَّخِذُونَ مِنْهُ سَكَرًا وَرِزْقًا حَسَنًا إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
এবং খেজুর বৃক্ষের ফল ও আঙ্গুর হতে তোমরা মাদক ও উত্তম খাদ্য সংগ্রহ করে থাক, তবে অবশ্যই বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন। (সুরা নাহল: ৬৭)
তখন মদ অবৈধ ছিল না বিধায় মুসলমানদের অনেকেই সে সময় মদপান করতেন। পরবর্তী সময়ে হযরত উমর, মুয়ায ইবন জাবাল (রা) এবং আরো কতিপয় সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল। মদের ব্যাপারে আমাদেরকে ফাতওয়া দিন। এতে আকূল নষ্ট হয় এবং মাল ধ্বংস হয়। তখন নাযিল হলোঃ
يَسْتَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ والمهما أكبر من نفعهما .
লোকে আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্ক জিজ্ঞাসা করে। বলুন, উভয়ের মধ্যে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও আছে। কিন্তু তাদের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক। (সূরা বাকারা: ২১৯)
এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর কেউ কেউ মদপান করা ছেড়ে দেন আবার কেউ পূর্ববৎ মদপানে অভ্যস্ত থাকেন। এ সময়ের মধ্যে একবার হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা) কতিপয় সাহাবীকে দাওয়াত করেন। তারা খানা খাওয়ার পর মদপান করেন এবং উন্মাদ হয়ে পড়েন। এ সময় তাদের কোন একজন নামায পড়তে গিয়ে পাঠ করেন ফেলেন
قُلْ يُأَيُّهَا الكُفَرُونَ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ .
১ অক্ষরটি বাদ দিয়ে পাঠ করেন। তখন আল্লাহ্ তা’আলা নিম্নের আয়াতটি
নাযিল করলেন: يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تَقْرَبُوا الصلوة وانْتُمْ سُكْرَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا
تَقُولُونَ
হে মু’মিনগণ! মদ্যপানোন্মত্ত্ব অবস্থায় তোমরা নামাযের নিকটবর্তী হবে না, যতক্ষণ না তোমরা যা বল তা বুঝতে পার। (সূরা নিসাঃ ৪৩) এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর মদ্যপায়ী লোকদের সংখ্যা প্রচুর হ্রাস পায়। পরবর্তীতে উসমান ইবন মালিক (রা) একদল আনসারী সাহাবীকে তাঁর বাড়িতে খাওয়ার জন্য দাওয়াত করেন। তারা খানা খাওয়ার পর মদপান করে উন্মাদ হয়ে পড়েন। এ সময় হযরত সা’দ ইবন আবু ওয়াক্কাস (রা) একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। এতে তিনি আনসারদের দোষারোপ করে নিজেদের খুব গুণগান বর্ণনা করেন। এ কবিতা শুনে এক আনসারী যুবক রাগান্বিত হয়ে উটের গণ্ড দেশের একটি হাড় হযরত সা’দ (রা)-এর মাথায় ছুড়ে মারেন। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পড়ে সা’দ (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে উক্ত আনসারী যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) দু’আ করলেন:
اللهم بين لنا في الخمر بيانا شافيا
হে আল্লাহ। মদ সম্পর্কে আমাদেরকে একটি পরিষ্কার বিধান বলে দিন। হযরত উমর (রা) ও আল্লাহর দরবারে অনুরূপ দু’আ করেছেন বলে হাদীসে বর্ণিত রয়েছে। তখনই আল্লাহ তা’আলা নাযিল করলেনঃ
يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ منْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ أن يُوقِعَ بَيْنَكُمْ وَالْعَداوَةَ وَالْبَغْضَاء فِي الْخَمْرِ والميسر وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَعَنِ الصَلوةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ.
হে মু’মিনগণ। মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণয়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর তাহলে তোমরা সফলকাম হতে পারবে। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে ও সালাতে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না। (সূরা মায়িদা: ৯০-৯১)
(আল-ফিকহ আলাল মাযাহিবিল আরবা’আ, ৫ম খণ্ড, ও মা’আরিফুল কুরআন (সংক্ষিপ্ত)
আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা) একজন ঘোষককে তা প্রচারের জন্য নির্দেশ দিলেন। তিনি মদীনার গলি গলি ঘুরে এ কথার ঘোষণা করলেন এবং এ হুকুম সর্বত্র পৌছিয়ে দিলেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, আমি আবু তালহা (রা)-এর ঘরে লোকদেরকে মদ পরিবেশন করছিলাম। তখনই মদের নিষেধাজ্ঞা অবতীর্ণ হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) একজন ঘোষককে তা প্রচারের নির্দেশ দেন। উক্ত ব্যক্তি এ মর্মে ঘোষণা দিলেন। তখন আবু তালহা (রা) আমাকে বললেন, বেরিয়ে দেখ তো ঘোষণা কিসের? হযরত আনাস (রা) বলেন, আমি বেরুলাম এবং এসে বললাম, একজন ঘোষক ঘোষণা দিচ্ছে যে, জেনে রাখ মদ হারাম করে দেওয়া হয়েছে। এরপর তিনি আমাকে বললেন, যাও: এগুলো সব ঢেলে দাও। (আনাস রা) বলেন, সেদিন মদীনা মুনাওয়ারার রাস্তায় রাস্তায় মদের স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল। (বুখারী, ২য় খণ্ড)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, “মদপান করা হারাম” একথাটি একবারে নাযিল হয়নি। বরং পর্যায়ক্রমে তা নাযিল হয়েছে। এর কারণ বিশ্লেষণ করে আলিমগণ বলেন যে, তখনকার লোকেরা মদ্যপানে খুবই অভ্যন্ত ছিলেন। কাজেই একবারে মদ্যপানের নিষেধাজ্ঞার হুক্কম অবতীর্ণ হলে, এ হুকুম পালন ও বাস্তবায়িত করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হতো।
তাঁদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে আল্লাহ তা’আলা এ হুকুম একবার নাযিল না করে পর্যায়ক্রমে নাযিল করেছেন। (প্রাগুক্ত)