ইমামগণের সর্বসম্মত রায় হলো, যদি চোরের উপর হস্ত কর্তনের ‘হদ্দ’ সাব্যস্ত হয় এবং এটাই যদি তার প্রথম চুরি ও এই চুরির অপরাধে তার উপর এই প্রথম বারের মত ‘হদ্দ’ আরোপিত হতে যাচ্ছে এমতাবস্থায় যদি তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও সব সুস্থ-সঠিক থাকে তাহলে তার ডান হাতের কব্জি কর্তন করা হবে। এরপর কর্তিত স্থান থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে, সর্বকর্মে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে বিধায় সর্বপ্রথম চুরির শান্তি হিসেবে ডান হাত কাটার বিধান দেয়া হয়। (কিতাবুল ফিক্ আলাল মাযাহিবিল আরবা’আ ৫ম খণ্ড)
এই বিধানের মূলনীতি পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহতে বিদ্যমান রয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআন মজীদে মহান আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেন:
والسَّارِقُ والسَّارِقَةُ فَقَطَعُوا أَيْدِيَهُمَا جَزَاءًا بِمَا كَسَبَا نَكَالًا مِّنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ .
পুরুষ চোর ও নারী চোরের হাত কেটে দাও তাদের কৃতকর্মের সাজা হিসেবে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আদর্শদণ্ড এবং আল্লহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা মায়িদা ৪৮)
বস্তুত প্রথম চুরির অপরাধে প্রথমবার চোরের ডান হাত কাটার এই বিধান পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ্ দ্বারা প্রমাণিত এবং এর উপর ইজমা-ই-সাহাবা ও ইজমা-ই-উম্মত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সেই চোর যদি দ্বিতীয়বার চুরি করে এবং তার উপর কর্তনের দণ্ড বর্তায়, তাহলে এবার তার বাম পা কাটা হবে। বাম পায়ের গোড়ালি থেকে নিম্নাংশ কেটে ফেলতে হবে। এবং সেই ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে।
বস্তুত প্রথম ও দ্বিতীয় বারের চুরির শাস্তি প্রদানের ব্যাপারে কারো কোনরূপ মতানৈক্য নেই। প্রথম চুরির শাস্তি ডান হাত কর্তন এবং দ্বিতীয় চুরির শাস্তি চোরের বাম পা কর্তন। এ ব্যাপারে সকল ইমামই একমত। কিন্তু একই চোর কর্তৃক যদি তৃতীয়বার ও চতুর্থবার চৌর্যকর্ম সম্পাদিত হয়, তাহলে তার শাস্তি সম্পর্কে ইমামগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
হানাফী ইমামগণের মতে, ডান হাত এবং বাম পা কাটার পরেও যদি কোন চোর আবার চুরি করে, তাহলে তার উপর চুরির ‘হদ্দ তথা কর্তনের শাস্তি আর প্রযোজ্য হবে না। বরং তাকে তখন ‘তাযীর’-এর আওতায় শাস্তি দেওয়া হবে। চোরের নিকট থেকে তখন চুরির মাল ফেরত নেয়া হবে অথবা মূল্য আদায় করা এবং তাকে বন্দী করা হবে ও প্রহার করা হবে। যাতে করে সে চৌর্যবৃত্তি পরিত্যাগ করে, তাওবা করে এবং সংশোধিত হয়ে যায়। এই বিধানের মূল তাৎপর্য হলো, ‘হদ্দ’ বিধিবদ্ধ হয়েছে শাসনের জন্যে ও সংশোধনের জন্য, মানুষের ধ্বংস সাধনের জন্যে নয়।
আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ফারুক (রা)-এর দরবারে চুরির অপরাধে হস্ত-পদ কর্তিত এক চোরকে বিচারের নিমিত্ত হাযির করা হয়েছিল। কারণ সে আবার চুরি করেছে। তাকে ‘সুদুম’ বলা হতো। হযরত উমর (রা) তার উপর আবার কর্তনের শাস্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেন। হযরত আলী মুরতাযা (রা) তখন হযরত উমর ফারুক (রা)-কে বললেন, তার হস্তপদ তো পূর্বেই কর্তন করা হয়েছে। অতএব এখন আবার তার উপর কর্তনের শাস্তি প্রয়োগ করা যাবে না। তখন হযরত উমর ফারুক (রা) তাঁর উপর আর কর্তনের ‘হদ্দ’ প্রয়োগ করেন নি বরং তাকে তিনি বন্দী করেছেন। বস্তুত হযরত আলী মুরতাযা (রা)-এর এই ‘ফাতওয়া’ এবং হযরত উমর ফরুক (রা) কর্তৃক সেই ‘ফাতওয়া’ কে নির্দিধায় গ্রহণ ও অন্য কোন সাহাবীর পক্ষ থেকে কোনরূপ আপত্তি উত্থাপিত না হওয়ার দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয়েছে যে, সাহাবা-ই-কিরাম কর্তৃক এই বিষয়ের উপর ইজমা-ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যদি কোন চোরের ডান হাত না থাকে, অথবা তার ডান হাত কাটা থাকে, তাহলে তার বাম পা গোড়ালি থেকে কর্তন করা হবে। যতি তার বাম পাও না থাকে কিংবা বাম পা গোড়ালি থেকে কর্তিত থাকে, তাহলে তার উপর কর্তনের ‘হদ্দ’ আর প্রয়োগ হবে না। এই অবস্থায় তার থেকে মাল অথবা তার ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে এবং তওবা করে সংশোধিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে বন্দী করে রাখা হবে। যদি চোরের বাম হাত কর্তিত কিংবা অকেজো থাকে অথবা তার বাম হাতের বৃদ্ধাংগুলী কিংবা এতদভিন্ন আরো দুই আঙ্গুল না থাকে। এক রিওয়ায়েতে তিন আঙ্গুল না থাকার কথা উল্লেখ আছে। অথবা তার ডান পা কর্তিত থাকে কিংবা অচল থাকে অথবা তার এমন প্রতিবন্ধকতা থাকে, যার কারণে সে এই পায়ের উপর নির্ভর করে চলাফেরা করতে পারে না। এমতাবস্থায় তার ডান হাত কিংবা বাম পা কে কাটা যাবে না। তার উপর কর্তন দণ্ড প্রয়োগ করা হলে সে একদম চলাফেরা ও ধরা ছোঁয়া থেকে মাহরুম হয়ে যাবে, যা তার জীবন নাশেরই শামিল।
হাত কাটার পদ্ধতি হলো, চোরকে বসান হবে এবং তাকে বাঁধা হবে। রশি দিয়ে তার হাত এমনভাবে টেনে বাঁধতে হবে, যাতে করে তার হাতের কজার জোড়া স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। এরপর তীক্ষ্ণ ধারাল কোন লোহা অস্ত্র দিয়ে তার হাত কর্তন করা হবে। তারপর কর্তিত স্থানে ছেঁক দিয়ে বা অন্য কোন ঔষধ ব্যবহার করে রক্তক্ষরণ বন্ধের ব্যবস্থা করা হবে। লোহার অস্ত্র থেকেও যদি কোন উন্নত মানের তীক্ষ্ণ ও ধারাল অস্ত্র পাওয়া যায় এবং তার দ্বারা কাটা সম্ভব হয়, তাহলে সেই অস্ত্রপ্রয়োগ করেও কাটা যাবে। কারণ, উদ্দেশ্য হলো ‘হদ্দ’ কার্যকর করা, কারো জীবন নাশ নয়। (কিতাবুল ফিক্ আলাল-মাযাহিবিল আরবা’আ, ৫ম খণ্ড ও আলমগীরী, ২য় খণ্ড)